প্রযুক্তি ব্যবহারে লিঙ্গবৈষম্য দূর করতে হবে

Originally posted in প্রথম আলো on 22 June 2021

বাংলাদেশে প্রায় সব ক্ষেত্রেই নারীরা এগিয়ে চললেও তথ্যপ্রযুক্তি খাতে তাঁরা এখনো প্রত্যাশিত মাত্রায় এগিয়ে আসতে পারেননি। টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) বাস্তবায়নে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তির ভূমিকা অপরিসীম। বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন ও সরকারি-বেসরকারি গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, তথ্যপ্রযুক্তি খাতে প্রবল মাত্রায় ‘লিঙ্গবৈষম্য’ রয়েছে। বিদ্যমান লিঙ্গবৈষম্য দূর করা না গেলে এসডিজি অর্জন সম্ভব হবে না।

কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা ও সুনামগঞ্জের হাওরাঞ্চলে দেখা গেছে, বেশির ভাগ গ্রামীণ নারী ইন্টারনেট সুবিধার বাইরে আছেন। সরকারের এক গবেষণায় (বাংলাদেশ ন্যাশনাল আইসিটি হাউসহোল্ড সার্ভে ২০১৮-১৯) দেখা গেছে, উত্তরদাতাদের মধ্যে ৫৩ দশমিক ২ শতাংশ পুরুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করেন বলে জানিয়েছেন, যার বিপরীতে নারীর হার ৩৪ দশমিক ২ শতাংশ। এ গবেষণায় ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে ৫৫ দশমিক ৬ শতাংশ লিঙ্গবৈষম্য পাওয়া গেছে। একটি বিদেশি সংস্থার প্রতিবেদনেও প্রায় একই চিত্র প্রকাশিত হয়েছিল, যেখানে বাংলাদেশে মোবাইল ইন্টারনেট গ্যাপ দেখানো হয় ৫৮ শতাংশ (দ্য মোবাইল জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্ট ২০১৯, লন্ডন, জিএসএমএ ২০১৯)।

ওই গবেষণার তথ্যে দেখা যায়, নারীদের মধ্যে যাঁরা ইন্টারনেট ব্যবহার করেন না বলে জানিয়েছেন, তাঁদের ৯৫ দশমিক ৪ শতাংশ বলেছেন, তাঁদের ইন্টারনেট ব্যবহারের অনুমতি নেই। অথচ এর বিপরীতে এমন পুরুষের হার মাত্র ৪ দশমিক ৬ শতাংশ। অন্যদিকে, নিরাপত্তার কারণে ইন্টারনেট ব্যবহার করেন না—এমন বলা পুরুষ মাত্র ৫ দশমিক ৪ শতাংশ, কিন্তু নারী ৯৪ দশমিক ৬ শতাংশ। এখান থেকে স্পষ্ট হয়, নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারে নারীরা পুরুষের তুলনায় অনেক বেশি চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। এখানে প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যায়, ২৯ শতাংশ পুরুষ বলেছেন, তাঁরা সময়ের অভাবে ইন্টারনেট ব্যবহার করেন না, কিন্তু এর বিপরীতে নারীর হার ৭১ শতাংশ। জনপরিসরে বাণিজ্যিকভাবে ইন্টারনেট সেবা প্রদানকারী স্থানগুলোয় (যেমন টেলিসেন্টার বা সাইবার ক্যাফে) গিয়ে এই সেবা গ্রহণকারী ব্যক্তিদের মধ্যে সিংহভাগই (৮০.৬%) পুরুষ।

করোনাকাল এখন নতুন বাস্তবতা। এক বছরের বেশি সময় ধরে মানুষ কার্যত গৃহবন্দী। হাওরাঞ্চলসহ দেশের সব অঞ্চলে ও সব মানুষের কাছে প্রযুক্তিকে সমানভাবে সহজলভ্য ও ব্যবহারযোগ্য করে তুলতে হবে। এ জন্য প্রাযুক্তিক প্রশিক্ষণ-পরামর্শ যেমন দরকার, তেমনি দরকার প্রয়োজনীয় ডিভাইস ও ইন্টারনেট সেবা সব মানুষের কাছে সুলভ করে তোলা

বাংলাদেশে গ্রামাঞ্চলে ইন্টারনেট ব্যবহারের মূল ক্ষেত্র সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকেন্দ্রিক। ২০১৮ সালে ডিজিটাল উই আর সোশ্যাল এবং হটস্যুইটের এক যৌথ গবেষণার প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশের অন্তত ৩০ মিলিয়ন ব্যক্তি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে। এ গবেষণার তথ্যমতে, বাংলাদেশে ফেসবুক সবচেয়ে জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। একই প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে ফেসবুক ব্যবহারকারীদের মধ্যে ২৪ শতাংশ প্রোফাইল নারীদের (দ্য ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস, ২৪ মার্চ ২০১৮)। অর্থাৎ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের ক্ষেত্রেও পুরুষের তুলনায় এখনো নারীরা অনেক পিছিয়ে।

হাওরাঞ্চল বাংলাদেশের অনগ্রসর গ্রামীণ জনপদগুলোর অন্যতম। ইংরেজি দৈনিক ঢাকা ট্রিবিউন-এ গত ২২ আগস্ট প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে এক গবেষণার বরাত দিয়ে বলা হয়, গ্রামাঞ্চলে বসবাসকারী ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী নারীদের মাত্র ১০ শতাংশ ইন্টারনেট ব্যবহার করেন, যেখানে শহরাঞ্চলের ক্ষেত্রে এ হার ২০ শতাংশ। এখানে দেখা যাচ্ছে, দেশের যুবশক্তির অর্ধেক অংশ নারীদের মধ্যে ইন্টারনেট অভিগম্যতার হার রীতিমতো হতাশাজনক। অথচ এ বয়সী নারী-পুরুষই তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত ও সম্ভাবনাময় জনগোষ্ঠী।

একই প্রতিবেদনের তথ্যমতে, নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোর তরুণদের মধ্যে ৭২ শতাংশের নিজস্ব ফোন রয়েছে, যেখানে উচ্চ আয়ভুক্ত পরিবারের ক্ষেত্রে এ হার ৯২ শতাংশ। নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোর তরুণীদের ২৪ শতাংশের নিজস্ব ফোন রয়েছে, যেখানে উচ্চ আয়ভুক্ত পরিবারের ক্ষেত্রে এ হার ৭৩ শতাংশ। তাহলে দারিদ্র্য একদিকে যেমন নারীর পক্ষে প্রযুক্তি ব্যবহারে বাধা, তেমনি জেন্ডারও এ ক্ষেত্রে একটি প্রভাবক হিসেবে প্রতীয়মান হচ্ছে। এ বৈষম্য দূর করা না গেলে দেশের জনগোষ্ঠীর সবচেয়ে সম্ভাবনাময় অংশের অর্ধেক যে নারী, তাঁরা উন্নয়ন কর্মকাণ্ড থেকে বাদ পড়বেন, যা দেশের সার্বিক উন্নয়ন–অগ্রযাত্রাকেও যে বাধাগ্রস্ত করবে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের পূর্বশর্ত হিসেবে প্রতিটি শহর, গ্রামসহ ইউনিয়ন পর্যায়ে ইন্টারনেট সেবা পৌঁছে দেওয়ার পথে কাজ তাহলে খুব বেশি এগোয়নি; এখানে আরও অনেক কাজ করা প্রয়োজন রয়েছে।

বাংলাদেশে তরুণদের মধ্যে একটি বড় অংশ ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে স্মার্টফোনের ওপর নির্ভরশীল। অথচ বাংলাদেশে মোবাইল ফোনের মালিকানার ক্ষেত্রে লিঙ্গবৈষম্য ২৯ শতাংশ এবং মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে লিঙ্গবৈষম্য ৫২ শতাংশ (দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, ৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১)।

ওপরের বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তের আলোকে দেখা যাচ্ছে, নারীরা ইন্টারনেট তথা নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে পুরুষের তুলনায় অনেক পিছিয়ে রয়েছেন। অনগ্রসর জনপদ হওয়ায় হাওরাঞ্চলে বসবাসকারী নারীরা সংগত কারণেই রয়েছেন আরও প্রান্তিক পর্যায়ে। নারী ও পুরুষ এবং গ্রাম ও শহরের মধ্যে প্রযুক্তি ব্যবহারের এ বৈষম্য নিরসন করতে হবে; নতুন প্রযুক্তির যে অপরিমেয় সম্ভাবনা, তা জাতীয় উন্নয়নে কাজে লাগাতে হবে। তথ্যপ্রযুক্তিকে যদি শহরের মতো গ্রামে এবং পুরুষের মতো নারীর কাছেও সহজে অভিগম্য করা যায়, তাহলে নতুন প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমে এর সার্বিক ও সামষ্টিক সুফল পাওয়া সম্ভব।

করোনাকাল এখন নতুন বাস্তবতা। এক বছরের বেশি সময় ধরে মানুষ কার্যত গৃহবন্দী। হাওরাঞ্চলসহ দেশের সব অঞ্চলে ও সব মানুষের কাছে প্রযুক্তিকে সমানভাবে সহজলভ্য ও ব্যবহারযোগ্য করে তুলতে হবে। এ জন্য প্রাযুক্তিক প্রশিক্ষণ-পরামর্শ যেমন দরকার, তেমনি দরকার প্রয়োজনীয় ডিভাইস ও ইন্টারনেট সেবা সব মানুষের কাছে সুলভ করে তোলা। প্রযুক্তিকে নারীর জন্য নিরাপদ তথা নারীবান্ধব করে তোলাও জরুরি। প্রযুক্তি ব্যবহারে লিঙ্গবৈষম্য কমালে নারীর সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন হবে এবং নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। প্রযুক্তির ব্যবহারে জনগোষ্ঠীর সবাইকে উৎসাহী ও দক্ষ করে গড়ে তুলতে পারলে সব মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত হবে, যা এসডিজি পূরণে জোরালো ভূমিকা রাখবে।

ফিরোজ চৌধুরী প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক

2021-07-14T23:16:31+06:00June 22nd, 2021|News in the Media|

This Is A Custom Widget

This Sliding Bar can be switched on or off in theme options, and can take any widget you throw at it or even fill it with your custom HTML Code. Its perfect for grabbing the attention of your viewers. Choose between 1, 2, 3 or 4 columns, set the background color, widget divider color, activate transparency, a top border or fully disable it on desktop and mobile.

This Is A Custom Widget

This Sliding Bar can be switched on or off in theme options, and can take any widget you throw at it or even fill it with your custom HTML Code. Its perfect for grabbing the attention of your viewers. Choose between 1, 2, 3 or 4 columns, set the background color, widget divider color, activate transparency, a top border or fully disable it on desktop and mobile.