Originally posted in সমকাল on 21 June 2021
হুমকির মুখে কৃষি মৎস্য চাষ ও জনস্বাস্থ্য
স্বাদু পানির সুরক্ষিত আধার বরিশালের কীর্তনখোলা নদী। শুস্ক মৌসুমেও মিষ্টি পানির প্রবাহ থাকে। কিন্তু গত মার্চে হঠাৎ সুরক্ষিত এ এলাকায় অস্বাভাবিক লবণাক্ত পানি উজানের দিকে ধেয়ে আসে। দেড়শ কিলোমিটারের বেশি এলাকায় লবণাক্ততা ছড়িয়ে যায়। পানিতে লবণাক্ততা সহনীয় মাত্রার চেয়ে কয়েকগুণ বৃদ্ধি পায়। একইভাবে বরগুনার বিষখালী, পটুয়াখালীর লোহালিয়া নদী, পায়রা নদীর আমতলী অংশ এবং বলেশ্বর নদের পাথরঘাটার চরদুয়ানি অংশে লবণের আগ্রাসনে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন স্থানীয়রা। শুধু বরিশাল অঞ্চল নয়, লবণ পানিতে বিপন্ন দেশের দক্ষিণাঞ্চলসহ বিভিন্ন উপকূলীয় এলাকার মানুষের জীবন। নদনদীতে অস্বাভাবিক লবণাক্ততার প্রভাবে পাল্টে যাচ্ছে পুরো উপকূলের পানি, মাটি ও পরিবেশের গুণগত চরিত্র। মানুষের সুপেয় পানির যেমন অভাব দেখা দিচ্ছে, তেমনি কৃষি, মৎস্য চাষ ও জনস্বাস্থ্য হুমকির মুখে পড়েছে। দুর্যোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মিষ্টি পানির আধারগুলোতেও লবণাক্ততার মাত্রা বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি ভয়াবহ বার্তা। সমস্যা প্রতিরোধে এখনই সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ না করলে বড় ধরনের বিপর্যয় দেখা দেবে। বাধাগ্রস্ত হবে সরকারের এসডিজি অর্জন।
বঙ্গোপসাগর থেকে ১৩০ কিলোমিটার দূরের কীর্তনখোলা নদীতে গত ফেব্রুয়ারিতে পানির তড়িৎ পরিবাহিতা বা ইলেকট্রিক্যাল কনডাক্টিভিটি (ইসি) ছিল প্রতি সেন্টিমিটারে ৩০০ থেকে ৪০০ মাইক্রো সিমেন্স পর্যন্ত। কিন্তু মার্চে নাটকীয়ভাবে এই মান বেড়ে হয় প্রতি সেন্টিমিটারে এক হাজার ৩৬২ মাইক্রো সিমেন্স। অথচ পানিতে লবণাক্ততার সহনীয় মাত্রা হচ্ছে প্রতি সেন্টিমিটারে ৭৫০ মাইক্রো সিমেন্স। বরিশাল আঞ্চলিক মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট, পরিবেশ অধিদপ্তর এবং পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) থেকে এসব তথ্য পাওয়া যায়।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের বরিশাল শাখার সমন্বয়ক রফিকুল আলম বলেন, উজানে পানির প্রবাহ কমলে সাগরের উচ্চতা বেশি থাকায় সাগরের পানি জোয়ারে সময় নদীতে চলে আসে। আরও ১০ বছর আগে তেঁতুলিয়াও লবণ পানির ঢুকেছে। এবার কীর্তনখোলায় এলো। ভবিষ্যতে শুস্ক মৌসুমে ও জোয়ারের সময় লবণ পানি আরও ওপরের দিকে উঠবে। এ অবস্থা থেকে সমাধানের উপায় তুলে ধরে তিনি বলেন, হিমালয় থেকে যে নদীগুলো আসে এর মধ্যে ভারত থেকে ৫৪টি নদী এবং অন্যান্য তিনটিসহ মোট ৫৭টি নদীর পানি আমাদের দেশে প্রবেশ করছে। ভারত তাদের দেশের প্রতিটি নদীতে বাঁধ তো দিচ্ছেই, তার ওপর ৫৪টি নদীর মধ্যে ৩০টি নদীতে আন্তঃসংযোগ প্রকল্প করছে। আন্তঃপানি প্রত্যাহারের জন্য আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প করছে। তাদের পানি প্রত্যাহারের কারণে আমরা শুস্ক মৌসুমে পানি কম পাচ্ছি আবার বর্ষায় প্রচুর পানি আমাদের দিকে ছেড়ে দিচ্ছে। তখন দেশে বন্যা হচ্ছে। জাতিসংঘ পানিপ্রবাহ কনভেনশন ১৯৯৭-এ বাংলাদেশকে অনুস্বাক্ষর করতে হবে। অববাহিকাভিত্তিক একটি পানির সমঝোতা ও ন্যায্য হিস্যা নিতে জয়েন্ট রিভার কমিশনকে উদ্যোগী হয়ে ভূমিকা রাখতে হবে।
লবণ পানির জন্য গবেষকরা সমুদ্রপৃষ্ঠের পানির উচ্চতা বৃদ্ধিকে দায়ী করলেও সম্প্রতি বঙ্গোপসাগর সংলগ্ন বাংলাদেশের দক্ষিণ উপকূলীয় অঞ্চলে অবস্থিত বিআইডব্লিউটিএর পাঁচটি গেজ স্টেশনের তথ্য-উপাত্ত বিশ্নেষণ করে দেখা গেছে, স্বাধীনতার পর থেকে ওই স্থানগুলোর পানি ০ দশমিক ৫১ মিটার কমেছে।
পানিতে লবণাক্ততার পরিমাণ বাড়ার ফলে বিশুদ্ধ পানির সংকটে উপকূলের মানুষ বিভিন্ন ধরনের পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। ২০১৯ সালে বিশ্বব্যাংকের গবেষণায় বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার ২০ শতাংশ নারী লবণাক্ততার কারণে অকালগর্ভপাতের শিকার হন বলে তথ্য উঠে এসেছে।
সাতক্ষীরার আশাশুনি, শ্যামনগর এবং খুলনার কয়রা, দাকোপ ও পাইকগাছা উপজেলার বিভিন্ন এলাকার মানুষ সারা বছর লবণাক্ত পানিতে বন্দি রয়েছে। গত মে মাসে ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের কবলে পড়ে এখনও পানিবন্দি সাতক্ষীরার আশাশুনির প্রতাপনগর ইউনিয়নের হরিষখালী, কুঁড়িকাহুনিয়া, সুভদ্রকাটি অঞ্চল; শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা, পশ্চিম পাতাখালী; খুলনার কয়রা উপজেলার আংটিহারা এলাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ। চারদিকে পানি থাকলেও বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটের উপকূলজুড়ে নলকূপের পানি নোনা হয়ে গেছে।
শ্যামনগরের গাবুরার কৃষক আতিকুর রহমান বলেন, লবণ ফসলের জন্য ক্ষতিকর। লবণের সঙ্গে যুদ্ধ করেই টিকে আছি। আমাদের অন্য কোথাও যাওয়ার সামর্থ্য নেই। আতিকুর রহমানের প্রতিবেশী জোছনা আক্তার এলাকা থেকে চলে যেতে চান। তিনি বলেন, এখানে জীবনযাপন খুব কঠিন। দুটি শিশুসন্তান অসুস্থ হয়ে পড়েছে। লবণাক্ততার সঙ্গে যুদ্ধ করে আর টিকতে পারছি না।
পরিবেশ বিজ্ঞানী ড. সালিমুল হক বলেন, উপকূলের মানুষ লবণাক্ততা সহ্য করতে পারে এমন প্রজাতির ধান চাষ করছে, অনেকে ধান ছেড়ে চিংড়ি চাষ করছে, কোথাওবা বৃষ্টির পানি ধরে রাখা হচ্ছে। পরিবর্তিত পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার পদক্ষেপ নিতে হবে। এ বিষয়ে জনগণকে সচেতন করতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। বিশুদ্ধ পানি সংরক্ষণে প্রযুক্তিবান্ধব সংরক্ষণাগার স্থাপন করতে হবে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, অ্যাডাপটেশনের একটা সীমা আছে। নোনাপানি আরও বেড়ে গেলে সেখানে আর লোক বাস করতে পারবে না।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের সহযোগিতায় অক্সফ্যাম ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) ‘গণতান্ত্রিক সুশাসনে জনসম্পৃক্ত প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণ’ শিরোনামে বাংলাদেশের ১৩টি জেলায় একটি প্রকল্পে কাজ করছে। এ প্রকল্পের আওতায় স্থানীয় মানুষকে সংগঠিত করে বিভিন্ন রকম প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নেতৃত্বের বিকাশ ও সামাজিক নিরীক্ষা পরিচালনায় দক্ষতা বৃদ্ধি করা হয়। এ দক্ষতার আলোকে স্থানীয় পর্যায়ে সরকারের বিভিন্ন পরিষেবার ওপর সামাজিক নিরীক্ষা পরিচালনা করা হয়। নিরীক্ষার ফলাফল সরকারি সেবা প্রদানকারীর সামনে উপস্থাপন করা হয়। এ সামাজিক নিরীক্ষণ প্রক্রিয়ায় সেবা প্রদানকারীর সঙ্গে স্থানীয় জনগণের সম্পর্ক তৈরি হয়। জনগণও মতামত প্রকাশ করতে পারে। প্রকল্পের আওতায় এসডিজি বাস্তবায়নে স্থানীয় মানুষকে শক্তিশালী করা, প্রান্তিক ও বিপদাপন্ন নারী-পুরুষের অর্থনৈতিক ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা, জেন্ডার সমতা আনায়ন ও অসমতা হ্রাস, নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন, জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো ও দুর্যোগের ঝুঁকি হ্রাসে সচেতনতা বৃদ্ধির কাজ চলছে। এতে সেবা প্রদানকারীর দায়িত্ববোধ, জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত হয়। বিভিন্ন জেলায় এর সুফল মিলছে। অনেক এলাকায় কৃষক লবণসহিষুষ্ণ ফসল চাষ করছেন। লবণাক্ত জমি চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে কৃষি বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসূত্র তৈরি করে দিচ্ছে অক্সফ্যাম।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ প্রকল্পের মতো বাংলাদেশের অন্য জেলাগুলোতে সরকারি সেবার ওপর সাধারণ মানুষকে সংযুক্ত করে স্থানীয় প্রশাসন সামাজিক নিরীক্ষা পরিচালিত করতে পারে। এতে সরকারি সেবার মান বাড়বে। তারা আরও বলেন, উপকূলে লবণাক্ততাসহ নানা দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রকল্প গ্রহণ ও তা বাস্তবায়নে স্থানীয় জনগণ ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করতে হবে। দুর্যোগ ঝুঁকিতে থাকা নারী ও শিশুদের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় নিতে হবে। লবণাক্ত ও খরাসহিষুষ্ণ ফসলের জাত উদ্ভাবন, লবণ সহনশীল কৃষি কাজ ও বিকল্প জীবিকায়নে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করতে হবে। এসব কাজের জন্য জাতীয় বাজেটে সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ ও বিশেষ বরাদ্দ রাখা প্রয়োজন।