Originally posted in প্রথম আলো on 22 June 2021
পিরোজপুরের গ্রামাঞ্চলের কৃষক পরিবারের নারীদের দুঃখের যেন শেষ নেই। এক দশক আগেও খেতভরা ফসল দেখে তাঁদের মন খুশিতে ভরে উঠত। কিন্তু কয়েক বছর ধরে খেতে ফসল এলে তাঁদের মনে দুশ্চিন্তা এসে ভর করে। কারণ, আকস্মিক খরা কিংবা বন্যায় প্রায়ই ভেসে যাচ্ছে তাঁদের কষ্টের ফসল। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে পারিবারিক কলহ, নারী ও শিশু নির্যাতন। এই অঞ্চলের নারীরা প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন। অর্থনৈতিক দুরবস্থার কারণে অনেক পরিবারই মেয়েদের বাল্যবিবাহ দিয়ে দিচ্ছে।
জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত অভিঘাত শুধু পিরোজপুরের গ্রামের কৃষক পরিবারগুলোরই দুশ্চিন্তার কারণ নয়, বরগুনা, সাতক্ষীরা ও চট্টগ্রামের উপকূলীয় অঞ্চলের নারীদের অবস্থাও কমবেশি একই রকম। দক্ষিণের উপকূলীয় গ্রামাঞ্চলে যেমন অনাবৃষ্টি ও খরায় তাদের ফসল নষ্ট হচ্ছে, অন্য সময়টিতে খেতের পর খেত তলিয়ে যাচ্ছে অতিবৃষ্টি ও বন্যার কারণে। উপকূলবাসীর জন্য বাড়তি ভোগান্তি হিসেবে যোগ হয়েছে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট বায়ুচাপ-ঝড়।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সহযোগিতায় অক্সফাম ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) ‘গণতান্ত্রিক সুশাসনে জনসম্পৃক্ত প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণ’ প্রকল্পের আওতায় ‘জেন্ডার সমতা ও নারীর ক্ষমতায়নে সরকারি পরিষেবার ভূমিকা’ শিরোনামে এক গবেষণা করেছে। সেখানে জেন্ডার গ্যাপ বা লিঙ্গবৈষম্য কমানোর ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়েছে বরগুনার আমতলীর আকলিমা খাতুনের (ছদ্মনাম) ওপর। ২৪ বছর বয়সী এই নারীর পরপর দুইবার গর্ভপাত হয়েছে। এর ওপর যোগ হয়েছে পরিবারের অভাব। পুষ্টির অভাবে তিনি এখন নিয়মিতই অসুস্থ থাকেন।
পরিবারপ্রধান কৃষক আবদুর রহিম তালুকদার (৪৩) জানান, ঋণ নিয়ে চাষাবাদ করে এখন তিনি দিশেহারা। না পারছেন সংসার চালাতে, না পারছেন ঋণ পরিশোধ করতে। পিরোজপুরের ভান্ডারিয়ার বিলকিস আক্তার (২৩), সাতক্ষীরার তালার হালিমা খাতুন (২৮), চট্টগ্রামের পটিয়ার হাফসা বেগমসহ (২১) অনেকেই কমবেশি নারীস্বাস্থ্যের জটিলতায় ভুগছেন।
বাংলাদেশ ধাত্রী ও গাইনোকলজি সোসাইটির (ওজিএসবি) সাবেক প্রেসিডেন্ট সামিনা চৌধুরী বলেন, ‘দুর্যোগে ও বন্যায় নারীরা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতির মধ্যে পড়েন। আশ্রয়কেন্দ্রে উপকূলবাসী নারীদের পর্যাপ্ত পুষ্টি ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা দরকার। ত্রাণের মধ্যে স্বাস্থ্য উপকরণও অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। স্থানীয় মানুষের চাহিদার কথা শুনে তাদের মতো করে নারী ও কিশোরীদের স্বাস্থ্যসেবা স্থানীয় পর্যায়ের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে প্রদানের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।’
বাংলাদেশের অন্য অঞ্চলের মতো উপকূলীয় অঞ্চলের বেশির ভাগ কৃষক পুরুষ। কৃষক পরিবারে অর্থনৈতিক দুরবস্থার কারণে বিভিন্ন পরিবারে নারী ও শিশু নির্যাতন বাড়ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে বাল্যবিবাহ। এসব অঞ্চলের কয়েকজন নারীর সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে, যাঁরা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক। এসবই সীমাবদ্ধতা বাংলাদেশ পরিপ্রেক্ষিতে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) বাস্তবায়নের অন্যতম বাধা হয়ে দেখা দিতে পারে।
কয়েক বছর আগেও উন্নত দেশগুলো বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ব্যাপারটিকে হেসে উড়িয়ে দিয়েছে। ওই সব দেশ এই উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী হলেও তারা এর দায় এখনো খুব একটা স্বীকার করতে চায় না। কিন্তু বড় দেশগুলোর এই উদাসীনতার মূল্য ঠিকই দিতে হচ্ছে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর সাধারণ মানুষদের। বিশেষ করে নারীদের।
জাতিসংঘের ১৫ বছর মেয়াদি এসডিজি পরিকল্পনায় ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বে শান্তি ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। এই লক্ষ্য পূরণের জন্য দারিদ্র্য দূরীকরণ, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, সুস্বাস্থ্য ও উন্নত শিক্ষা নিশ্চিত করা এবং লিঙ্গবৈষম্য প্রতিরোধ করা অন্যতম। কিন্তু একাধিক গবেষণার তথ্যে ও গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, আবহাওয়ার বিরূপ প্রভাবের কারণে দেশের কৃষি ও উৎপাদনব্যবস্থা সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এসব এলাকার বাসিন্দারা তাদের কৃষিসম্পদ যেমন হারাচ্ছেন, তেমনি হারাচ্ছেন ভিটে-বাড়ি। এসব পরিবারের শিশুরা স্কুল থেকে ঝরে পড়ছে। একের পর এক দুর্যোগ, লবণাক্ততা বৃদ্ধি ও সুপেয় পানির অভাবে তাদের মধ্যে অপুষ্টি ও রোগব্যাধির প্রকোপ বাড়ছে।
উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে ঝড়-জলোচ্ছ্বাস বেড়েছে। একের পর এক দুর্যোগের প্রভাবে ওই সব এলাকার ফসলি জমি, মাছের ঘেরসহ অন্যান্য সম্পদ বিলীন যাচ্ছে। ফলে উপকূলবাসীর জীবন-জীবিকা অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে। সম্পদ হারিয়ে এসব এলাকার মানুষের দারিদ্র্য বাড়ছে। নারী ও কিশোরী স্বাস্থ্যসেবা ঝুঁকির সম্মুখীন হচ্ছে। বাড়ছে মাতৃমৃত্যু।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ভালনারেবিলিটি স্টাডিজের পরিচালক ও অধ্যাপক মাহবুবা নাসরীন বলেন, ‘দুর্যোগে উপকূলীয় নারীর জন্য করণীয় প্রসঙ্গে আমি বলব, আশ্রয়কেন্দ্রগুলো নারীবান্ধব করা। আগে পরিস্থিতি খুবই খারাপ ছিল, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এর অনেক উন্নতি হয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রে শিশুদের মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানো বা নারীদের জন্য আলাদা শৌচাগারের সুব্যবস্থা রাখা খুবই জরুরি।’
উপকূলীয় অঞ্চলকে বিবেচনায় নিয়ে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া দরকার। নারী ও কন্যাশিশুদের সুরক্ষায় বাড়তি যত্ন নেওয়া প্রয়োজন। আর যেকোনো পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের সময় অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে, তা নারীবান্ধব হচ্ছে কি না। তা না হলে জীবন রক্ষা ও নারী স্বাস্থ্য সুরক্ষার মতো বিষয়গুলো অনিশ্চিতই থেকে যাবে।