Originally posted in সমকাল on 18 June 2021
মে মাসে ঘূর্ণিঝড় ইয়াস ও পূর্ণিমার প্রভাবে উপকূলের বেড়িবাঁধগুলোর বড় একটি অংশ ভেঙে তছনছ হয়ে যায়। ফলে খুলনা থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত উপকূলীয় বিভিন্ন জেলার নিম্নাঞ্চল ভেসে যায়, প্লাবিত হয় শত শত গ্রাম আর কয়েক হাজার মাছের ঘের। নষ্ট হয় উঠতি ফসল। ক্ষতিগ্রস্ত হয় সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুর জেলার ২৭টি উপজেলা। ঘূর্ণিঝড়ের প্রায় তিন সপ্তাহ পার হলেও ওই সব অঞ্চল থেকে নামেনি নোনাপানি। এখনও শত শত পরিবার জলাবদ্ধ অবস্থায়ই জীবনযাপন করছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রায় ১৭ হাজার কিলোমিটার বাঁধ রয়েছে। এর মধ্যে উপকূলীয় অঞ্চলেই রয়েছে পাঁচ হাজার ৭৫৭ কিলোমিটার; যার পুরোটাই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। বাঁধ সংস্কারে বিভিন্ন সময়ে প্রকল্পপ্প নেওয়া হলেও তা কাজে আসেনি। প্রতিটি দুর্যোগের পরই জোড়াতালি দিয়ে বাঁধ মেরামত করা হলেও নির্মাণ হয়নি টেকসই বাঁধ। ফলে সাতক্ষীরা-খুলনা-বরিশাল হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত পুরো উপকূল আছে চরম ঝুঁকির মুখে।
জানা যায়, খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরাসহ বিভিন্ন উপকূলীয় এলাকার বাঁধগুলোর নকশা করা হয় ষাটের দশকে। সরকারের পক্ষ থেকে বাঁধগুলোর উচ্চতা ১০ ফুট বলা হলেও বাস্তবে তিন থেকে আট ফুটের বেশি নেই। ২০২০ সালের ১৮ মে ঘূর্ণিঝড় আম্পানের সময় অন্তত ১২ থেকে ১৫ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, সামনের দিনগুলোতে এমন উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হলে তা মোকাবিলা করতে পারবে না বেড়িবাঁধগুলো।
এ ছাড়া চিংড়ি চাষিরা ঘেরে লবণাক্ত পানি ঢোকাতে বাঁধ ক্ষতিগ্রস্তত করেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। স্থানীয় বেশ কয়েকটি সূত্র জানায়, চিংড়ি চাষিরা ঘেরে পানি ঢোকাতে বাঁধে ছিদ্র করছে।
অনেকে আবার বাঁধ কেটে তাতে পাইপ বসিয়ে দিচ্ছে। এতে দুর্বল হয়ে যাচ্ছে বাঁধগুলো। এসব ঘটনায় আট শতাধিক মামলা হলেও ঠেকানো
যাচ্ছে না চিংড়ি ঘের মালিকদের।
ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে বাঁধের ভেঙে যাওয়া অংশ দিয়ে জোয়ারের সময় লোকালয়ে ঢুকছে পানি। নদীতে জোয়ারের পানি নেমে গেলেও এলাকাগুলো থেকে পানি পুরোপুরি সরছে না। ফলে এলাকাবাসীকে পোহাতে হচ্ছে দুর্ভোগ। বাগেরহাটের শরণখোলার সাউথখালী ইউনিয়নের মূল বেড়িবাঁধের বাইরে অসংখ্য পরিবার দিন কাটাচ্ছে এমন অসহায়ত্বে। এই এলাকার দক্ষিণ চালিতাবুনিয়া গ্রামে বলেশ্বর নদীর পাশে থাকা রিং বাঁধটি ভেঙে যাওয়ায় প্রতিদিন দু’বার জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হচ্ছে পরিবারগুলো। এখন পর্যন্ত সরকারি কোনো ত্রাণ পায়নি বলেও অভিযোগ করেন ভুক্তভোগীরা। এই বাঁধটি গত বছর ঘূর্ণিঝড় আম্পানের সময় ভেঙে গিয়েছিল। পরে এটি মেরামত করা হলেও ফের ভেঙে যায় ঘূর্ণিঝড় ইয়াসে।
দক্ষিণ চালিতাবুনিয়া গ্রামের এক কোনায় টিনশেড ঘর বানিয়ে থাকেন ষাটোর্ধ্ব বিধবা রাহেলা বেগম। জোয়ারের সময় তলিয়ে যাওয়া ঘরে বসবাসের উপায় থাকে না তার। রান্নার চুলা ডুবে যাওয়ায় কোনো কোনো দিন কাটাতে হয় শুকনা খাবার খেয়ে। ভাঙা বাঁধের কারণে সৃষ্ট জলাবদ্ধতা স্বাভাবিক জীবন কেড়ে নিয়েছে। গোসল, ধোয়া-মোছাসহ নিত্যদিনের সব কাজ নোনাপানিতেই সারতে হয়। আশপাশের ধান চাষের জমিগুলোতে জমে আছে গলাসমান পানি। চাষের সময় চলে এলেও পানি না সরায় চোখে-মুখে অন্ধকার দেখছেন তিনি। রাহেলা বেগম বলেন, ‘বন্যার সময়ে মেম্বর-চেয়ারম্যানরা দ্যাহা দেন না, অথচ ভোটের সময়ে অনেকবার আহেন দোয়া চাইতে। আমরা ডুইবা মরি, বান্দা (বাঁধ) মেরামতের কোনো ব্যবস্থা করে নাই।’
শুধু দৈনন্দিন জনজীবন ক্ষতিগ্রস্তই নয়, জোয়ারের পানিতে রাস্তাঘাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বাজার-ঘাট ভেঙে সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজও ব্যাহত হচ্ছে। প্রভাব পড়ছে এসব অঞ্চলের শিক্ষাব্যবস্থা, কর্মসংস্থান ও স্বাস্থ্যব্যবস্থায়। বেড়িবাঁধ ঠিকমতো সংস্কার বা পুনর্নির্মাণ করা না হলে উপকূলীয় অঞ্চলে এসডিজির বাস্তবায়ন হুমকির মুখে পড়বে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
স্থানীয়দের অভিযোগ, অতীতে বেড়িবাঁধ সংস্কার, নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণে স্থানীয় জনগণের মতামত উপেক্ষিত হয়েছে। ফলে প্রতি বছর সরকারি কোটি কোটি টাকা ব্যয় হলেও টেকসই বেড়িবাঁধ হয়নি। তাদের প্রধান দাবি- টেকসই বাঁধ।
এলাকাবাসীরা জানান, রিং বাঁধটির উচ্চতা ৮ থেকে ১০ ফুটের মতো ছিল। এবার মেরামতের সময়ে সেটিকে অন্তত ২০ ফুটের বেশি উঁচু করার দাবি জানান তারা। সেই সঙ্গে তারা প্রতিবার ভেঙে যাওয়া ঠেকাতে বাঁধ মজবুত করে বানানো এবং জোয়ারে যেসব জায়গায় বেশি চাপ পড়ে, সেসব জায়গায় নিরাপত্তার খাতিরে কংক্রিটের ব্লক ব্যবহারের মতও দেন। এ ছাড়া বাঁধে গাছ লাগানো হলে প্রাকৃতিকভাবেই বাঁধ সাধারণের চেয়ে সবল হবে বলেও মনে করেন স্থানীয়রা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাঁধ নির্মাণ প্রক্রিয়ায় জনগণকে সম্পৃক্ত করতে হবে। কোনো অনিয়ম হচ্ছে কিনা, তা মনিটরিংয়ের দায়িত্ব জনগণকে দিতে হবে। বাঁধ নির্মাণে বরাদ্দ, বরাদ্দের টাকা খরচের খাত সম্পর্কে জনগণকে উন্মুক্তভাবে অবহিত করতে হবে। যাতে বরাদ্দ অনুযায়ী কাজ হচ্ছে কিনা তা জনগণ বুঝতে পারে। সামাজিক নিরীক্ষা করে তা গণমাধ্যমকে জানাতে হবে। কত ফুট বাঁধ করা হবে এবং কাজ শুরুর সময়সহ নানা বিষয়ে জনগণের সঙ্গে আলাপ করেই নির্ধারণ করবে পানি উন্নয়ন বোর্ড। বাঁধ নির্মাণের পর এটি টেকসই করার ক্ষেত্রেও জনগণকে সম্পৃক্ত করতে হবে। এসব বিষয়ে গবেষকদেরও মতামত নিতে হবে। সরকারি সেবা সংস্থাগুলোর সঙ্গে জনগণের সম্পৃক্ততা বাড়লেই বাঁধ দীর্ঘস্থায়ী হবে বলে মনে করেন গবেষকরা।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের সহযোগিতায় অক্সফ্যাম ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) ‘গণতান্ত্রিক সুশাসনে জনসম্পৃক্ত প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণ’ শিরোনামে একটি সামাজিক নিরীক্ষা পরিচালিত করেছে। এ প্রকল্পের আওতায় জনগণের সঙ্গে স্থানীয় প্রশাসনের সম্পৃক্ততা বাড়ানোর বিষয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে জনগণ স্থানীয় সরকারের সেবা বিষয়ে সামাজিক নিরীক্ষা পরিচালনা করে। বাঁধ নির্মাণ নিয়েও স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে জনগণের যোগসূত্র স্থাপন করা উচিত বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, সরকার চাইলে অক্সফ্যাম ও সিপিডির প্রকল্পের মডেল কাজে লাগাতে পারে। এর ফলে উন্নয়ন টেকসই হওয়ার পাশাপাশি স্থানীয় পর্যায়ে সরকারি সেবা প্রদানকারীদের জবাদিহিতা ও স্বচ্ছতা তৈরি হবে।
স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করার সরকারি সিদ্ধান্ত রয়েছে উল্লেখ করে পানি উন্নয়ন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত সমকালকে বলেন, ২০১৩ সালের পানি আইন অনুযায়ী ২০১৮ সালে স্থানীয় পানি কমিটি গঠন করা হয়েছে এবং এই কমিটিকে রক্ষণাবেক্ষণের কাজে সম্পৃক্ত করার সরকারি সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়েছে। ২০১২ সালের দুর্যোগ আইন অনুযায়ী ২০১৬-১৭ সালের দিকে স্থানীয় পর্যায়ে দুর্যোগ কমিটি হয়েছে। সেই কমিটিকে বাঁধের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। সরকার দুটি আইন করে আলাদা দুটি মন্ত্রণালয়কে স্থানীয় জনগণকে বাঁধ রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দিয়েছে।
উপকূলের বেড়িবাঁধ টিকিয়ে রাখতে হলে সমন্বিত সিদ্ধান্ত প্রয়োজন বলে মনে করেন কোস্টাল জার্নালিজম স্পেশালিস্ট রফিকুল ইসলাম মন্টু। তিনি বলেন, আমরা উপকূল অঞ্চলের বাঁধ নিয়ে মেগা প্রকল্প হবে শুনতে চাই না। আমরা শুনতে চাই কাজটা শুরু হয়েছে। একটি বেড়িবাঁধ ভেঙে যাওয়ার পর এর আওতায় থাকা জনজীবনে অনেক সমস্যা দেখা দেয়। গত ২৫-৩০ বছরে যত উন্নয়ন হয়েছিল, প্রায় সব ভেস্তে গেছে। সবকিছু নতুন করে আবার করা লেগেছে। ইয়াসের পর পানি ঢুকে আবার সব শেষ হয়ে গেছে। এ সময় টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা না হলে এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা সম্ভব নয় বলেও মন্তব্য করেন তিনি।