Originally posted in সমকাল on 11 June 2021
যশোরের অভয়নগর উপজেলার শ্রীধরপুরের বাসিন্দা তানভীর আহমেদ পেশায় সাংবাদিক। শখের বশে বাড়ির পাশে দুই বিঘা জমিতে একটি পেয়ারা বাগান করেছেন। তিনি জমির মাটি পরীক্ষাসহ কিছু পরামর্শের জন্য উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার শরণাপন্ন হন। এক বছর আগে কৃষি কর্মকর্তা তাকে উপজেলা ব্লক সুপারভাইজার মো. ইউনুছের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। গত এক বছরে অন্তত ১০ বার ফোনে কথা বলার পরও তানভীরকে কোনো সহায়তা করেননি ব্লক সুপারভাইজার।
তানভীর ক্ষোভ প্রকাশ করে সমকালকে বলেন, ব্লক সুপারভাইজারা মাঠে থাকেন না। সহায়তা পেতে গেলে ভোগান্তির শিকার হতে হয়।
শ্রীধরপুর ইউনিয়নের শেখ জাহান অভিযোগ করেন, তিন বিঘা জমিতে লিচু বাগান করেছি। পরামর্শের জন্য কৃষি কর্মকর্তাদের পেছন পেছন ঘুরেও সহায়তা পাইনি।
শ্রীধরপুরের ব্লক সুপারভাইজার ইউনুছ সমকালকে বলেন, এ ইউনিয়নে চারজন ব্লক সুপারভাইজারের পদের বিপরীতে দু’জন রয়েছেন। ফলে দুর্গম এলাকায় ১০ হাজার কৃষককে সেবা দিতে কিছুটা সমস্যা হচ্ছে।
শুধু তানভীর কিংবা শেখ জাহান আলী নন, সরকারি সহায়তা পেতে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন দেশের অনেক প্রান্তিক কৃষক। সরকারি সেবা সম্পর্কে যাদের তেমন ধারণা নেই। নোয়াখালীর সুবর্ণচর, গাইবান্ধা, জামালপুর, রংপুর, কুড়িগ্রাম, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনাসহ দেশের বিভিন্ন জেলার শতাধিক কৃষকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে ভোগান্তি ও নানা অনিয়মের তথ্য। কোথাও কোথাও কৃষিযন্ত্র তাদের যন্ত্রণার কারণ। আবার তদবির ছাড়া মেলে না প্রণোদনাসহ আর্থিক সুবিধা। কৃষি তথ্য সার্ভিসের তথ্য পেতেও ভোগান্তি পোহাতে হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা-এসডিজি ও সূচকের দ্বিতীয় নম্বরে ক্ষুধার অবসান, খাদ্য নিরাপত্তা ও উন্নত পুষ্টিমান অর্জন এবং টেকসই কৃষির প্রসারের কথা বলা হয়েছে। সে লক্ষ্য চলতি বাজেটেও সরকার কৃষিকে বেশ গুরুত্ব দিয়ে বাড়িয়েছে বরাদ্দ। কিন্তু সরকারের সেবা প্রান্তিক কৃষকদের মাঝে সহজলভ্য করা না গেলে এসডিজি অর্জন ব্যাহত হবে। মাঠ পর্যায়ে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে মন্ত্রণালয় ও সংশ্নিষ্ট অধিদপ্তরের মনিটরিং বাড়ানোর ওপর জোর দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
যন্ত্র যখন যন্ত্রণার কারণ :তিন হাজার ২০ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পের আওতায় ২০১০ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত প্রায় ৬৯ হাজার ৮৬৮টি কম্বাইন্ড হারভেস্টার, রিপার, সিডার, পাওয়ার টিলারসহ কৃষি যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা হয়। এসব যন্ত্র ৭০ শতাংশ ভর্তুকিতে হাওর ও অন্য এলাকায় ৫০ শতাংশ ভর্তুকিতে বিতরণ করা হচ্ছে। চলতি অর্থবছরের মধ্যেই দেশের ৫০ উপজেলায় অন্তত পাঁচ হাজার ৭৭৬টি কৃষিযন্ত্র বিতরণ করা হবে বলে জানা গেছে। আগামী অর্থবছরের বাজেটে কৃষি যন্ত্রপাতি ক্রয়ে ৬৮০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
সম্প্রতি প্রকাশিত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় বলা হয়েছে, ফসল আবাদে চাষ, সেচ, নিড়ানি, কীটনাশক প্রয়োগে ৮০ থেকে ৯৫ শতাংশ যান্ত্রিকীকরণ হয়েছে। তবে ফসল রোপণ, সার দেওয়া, কাটা, মাড়াই, ঝাড়াই ও শুকানোর ক্ষেত্রে যন্ত্রের ব্যবহার ১ শতাংশের কম। এসব যন্ত্রের দাম বেশি হওয়ায় ভর্তুকি পাওয়ার পরও বাকি টাকা দিতে প্রান্তিক কৃষককে হিমশিম খেতে হচ্ছে। আবার বিভিন্ন এলাকায় যন্ত্রে ত্রুটিও দেখা দিয়েছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ার কৃষক তাহের মিয়া গত বোরো মৌসুমে মেটাল এগ্রিটেক কোম্পানির এফএম ওয়ার্ল্ড ব্র্যান্ডের একটি হারভেস্টার ২০ লাখ ৬৫ হাজার টাকায় ক্রয় করেন। এর মধ্যে সরকার ভর্তুকি দেয় ১০ লাখ ২৫ হাজার টাকা। কৃষক তাহের মিয়ার অভিযোগ, হারভেস্টার মাঠে নামার পর থেকে এক দিনের জন্যও ভালোভাবে ধান কাটা সম্ভব হয়নি। প্রতিদিন নষ্ট হয়।
মেটাল কোম্পানির আরও একটি হারভেস্টার নিয়েছিলেন আখাউড়ার মোগড়া ইউনিয়নের বাউতলা গ্রামের কৃষক নাসির উদ্দিন বাচ্চু। তিনি জানান, এক ঘণ্টা মেশিন চালু রাখলে পরবর্তী এক ঘণ্টা মেশিন বন্ধ রাখতে হয়।
আখাউড়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সাহানা বেগম বলেন, মেটাল কোম্পানির হারভেস্টারগুলোয় ত্রুটি দেখা দিচ্ছে বলে কৃষকরা অভিযোগ দিচ্ছেন। এই ব্র্যান্ডের যন্ত্র কৃষকদের মাঝে না দেওয়াই ভালো হবে।
গত বছরের মে মাসে বগুড়ার ধুনটে কৃষি কর্মকর্তা মুশিদুল হক যন্ত্র আছে এমন কৃষকের সঙ্গে যোগসাজশ করে অর্থ লুটের উদ্দেশ্যে তৈরি করেন ভুয়া বিল ও ভাউচার। বিষয়টি আগেই জানতে পেরে থানায় জিডি করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। পাবনার আটঘরিয়ায় গত বছরের জুলাইয়ে নিম্নমানের কৃষি যন্ত্রপাতি বিতরণের অভিযোগে বিক্ষোভ করেন কৃষকরা।
সুনামগঞ্জের তাহিরপুরসহ বিভিন্ন উপজেলার কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কম্বাইন হারভেস্টারের দাম পড়ে ২০ থেকে ৩৩ লাখ টাকা, পাওয়ার রিপারের দাম মডেলভেদে এক লাখ ৮০ হাজার থেকে দুই লাখ টাকা, রাইস ট্রান্সপ্লান্টারের মধ্যে ওয়াকিং টাইপের যন্ত্রের দাম আড়াই লাখ থেকে তিন লাখ টাকা। একই যন্ত্রের রাইডিং টাইপের দাম ১৭ লাখ টাকা। ট্রাক্টরের দাম ১২ থেকে ১৪ লাখ টাকা। উচ্চমূল্যের এসব পণ্যের ক্ষেত্রে সরকারের ভর্তুকি পাওয়া গেলেও ট্রাক্টর থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয় আরও অনেক যন্ত্রের ক্ষেত্রে ভর্তুকি পাওয়া যায় না। এ ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোও ঋণ সুবিধা দিতে আগ্রহী নয় বলে জানান কৃষকরা।
তাহিরপুরের কৃষক হেলাল উদ্দিন বলেন, সাধারণ কৃষকরা অর্থ সংকটসহ নানা শর্তের বেড়াজালে যন্ত্র কিনতে পারছেন না। অধিকাংশ যাচ্ছে প্রভাবশালীদের কাছে। তারা যন্ত্র কিনে বেশি অর্থে কৃষকদের কাছে ভাড়া দিচ্ছেন। এতে কৃষকদের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। যন্ত্রটি হস্তান্তরযোগ্য না হলেও অনেক উদ্যোক্তা ভর্তুকিতে কিনে বেশি দামে অন্যের কাছে বিক্রি করে দিচ্ছেন।
গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের কৃষক আব্দুর রহমান বলেন, রাস্তায় পুলিশ ট্রাক্টর চলতে দেয় না। মাঝেমধ্যে তেল নিতে শহরে যাওয়ার সময় হয়রানির শিকার হতে হয়। এ বিষয়ে নীতিমালা থাকা জরুরি।
লাভের বদলে ক্ষতি :৮ কোটি ৬৪ লাখ ৩৭ হাজার টাকার ‘সমলয় চাষাবাদ’ প্রকল্পের আওতায় জমি চাষ থেকে শুরু করে ফসল ঘরে তোলা পর্যন্ত সব খরচ বহন করার কথা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের। ৬১ জেলার একটি করে উপজেলায় এই প্রকল্প চালু হয়। বেশ কয়েকটি উপজেলার কৃষকরা জানান, সার, বীজ ও চারা বিতরণে অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতি করা হয়েছে।
চলতি মৌসুমে জয়পুরহাট সদর উপজেলার হিচমি-কোমরগ্রামের ফসলি মাঠের ৫০ একর জমিতে প্রকল্প চালু হয়। সুবিধাভোগী ৬৭ জনের মধ্যে অন্তত ১২ জন কৃষকের অভিযোগ, তারা শুধু বীজ আর সার পেয়েছেন। সেচ, পরিচর্যা ও মাড়াই করতে হয়েছে নিজেদের টাকায়। কৃষি বিভাগের লোকজন ঠিকমতো খোঁজও নেননি। এতে তাদের ক্ষতি হয়েছে।
এ বিষয়ে জয়পুরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক স ম মেফতাহুল বারি বলেন, কোনো কৃষক নিজ ইচ্ছায় ধান মাড়াই করলে তা ওই কৃষকের ব্যাপার। প্রকল্পে অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে কিনা, তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। একই রকম অভিযোগ পাওয়া গেছে ঝিনাইদহ, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবাসহ কয়েকটি উপজেলায়।
জামালপুরের সরিষাবাড়ীর কৃষক আলী আহম্মদ বলেন, মেম্বার-চেয়ারম্যানের কাছের লোকজনই বারবার সহায়তা পান। তাদের সুপারিশ ছাড়া সহায়তা দেওয়া হয় না।
কৃষি তথ্য সার্ভিসের সেবা পেতেও সমস্যা :কুড়িগ্রাম ও নেত্রকোনার কৃষক আবু হানিফ, কামাল উদ্দিন, মিজানুর রহমান ও তৌহিদুর রহমান জানান, কৃষি তথ্য সার্ভিসের একটি হটলাইনে শতাধিকবার ফোন করেও লাইন পাওয়া যায় না। সন্ধ্যার পর নম্বর বন্ধ থাকে। অন্যান্য তথ্যের বিষয়েও তাদের জানা নেই।
কৃষিভিত্তিক সর্বাধুনিক প্রযুক্তি, সেবা এবং তথ্য ছড়িয়ে দিতে ২০১২ সালে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনে কৃষি তথ্য সার্ভিসের পরিচালনায় ‘কৃষি কল সেন্টার’ চালু হয়। এ বিষয়ে কৃষি তথ্য সার্ভিসের পরিচালক কার্তিক চন্দ্র চক্রবর্তী সমকালকে বলেন, কল সেন্টারে মাত্র ৫ জন জনবল থাকায় সমস্যা হচ্ছে। অনেক সময় কলড্রপ হচ্ছে। করোনাকালে সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত সার্ভিস দেওয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, নিয়মিত সাময়িকী প্রকাশ, ভিডিও বার্তা, ফেসবুকে প্রচার, রেডিও-টিভিতে অনুষ্ঠান প্রচারসহ কৃষিবিষয়ক সব তথ্য সরবরাহ করা হয়। মাসিক কৃষি কথা নামে একটি সাময়িকী এবং বার্ষিক কৃষি ডায়েরি প্রকাশ হয়।
সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ধান কিনতে কৃষকদের জন্য ডিজিটাল অ্যাপ চালু হলেও প্রান্তিক পর্যায়ের অনেক কৃষক এর খবর জানেন না। নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ উপজেলার কৃষক আনিছুর রহমান সমকালকে বলেন, সরকারের ডিজিটাল সার্ভিস সম্পর্কে কৃষকদের প্রশিক্ষণ, তথ্য ও জ্ঞান নেই। শিক্ষিত কৃষি উদ্যোক্তারাই সরকারের ডিজিটাল সেবা ব্যবহার করেন।
বাংলাদেশ টেলিভিশনের মাটি ও মানুষের উপস্থাপক কৃষিবিদ মো. রেজাউল করিম সিদ্দিক বলেন, সরকারের সব সেবা তৃণমূলের কৃষকের কাছে যাচ্ছে না। কৃষক জানেন না কোথায় গেলে সেবা পাওয়া যায়। শতভাগ কৃষকের কাছে সেবা পৌঁছানো বড় চ্যালেঞ্জ। এ বিষয়ে কৃষকদের আরও সচেতন করা দরকার।
সরকারি সিস্টেমগুলো কৃষিবান্ধব হওয়া উচিত জানিয়ে তিনি বলেন, প্রণোদনাসহ কৃষি সহায়তার ক্ষেত্রে তালিকা তৈরিতে রাজনৈতিক চাপও কাজ করছে। জেলা কৃষি কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে বিষয়গুলো শক্তভাবে মনিটর করলে কৃষকের সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা দূর হতে পারে। তবে সেবা পেতে কৃষকদেরও সচেতন হতে হবে।
অক্সফাম বাংলাদেশের প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর সাইফুল আলম সমকালকে বলেন, সরকারি সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে স্থানীয়দের সঙ্গে নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর সংলাপ করা দরকার। কোন প্রক্রিয়ায় সেবা দিলে জনগণ উপকৃত হবে, সেই মতামত জানলে সেবার গুণগত মান বাড়বে। তৈরি হবে জবাবদিহিতা।