Originally posted in সমকাল on 16 June 2021
হিট শক ও শিলাবৃষ্টিতে ফসলের ক্ষতি হলেও এবার বোরো ধান উৎপাদন হয়েছে সর্বোচ্চ দুই কোটি সাত লাখ টন। তবে সোনালি ফসলেও অনেক কৃষকের মুখ হাসি নেই। চড়া সুদে গ্রামের মহাজন, ব্যাংক ও এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে ধান চাষ করেছেন তারা। এখন সুদসহ গুনতে হচ্ছে কয়েক গুণ টাকা। কিস্তির টাকা শোধ করতে প্রতি সপ্তাহেই তাগাদা দিচ্ছে এনজিওগুলো। ঋণের জালে আটকা পড়ে হাঁসফাঁস অবস্থা কৃষকের। শরীয়তপুর, টাঙ্গাইল, হবিগঞ্জ, মাদারীপুর, সিরাজগঞ্জ, জামালপুর, রংপুর, কিশোরগঞ্জসহ বেশ কয়েকটি এলাকার কৃষকরা এমন দুর্দশার বর্ণনা দিয়েছেন।
কৃষকরা জানান, সার, বীজসহ উপকরণ কেনার টাকা না থাকায় বাধ্য হন উচ্চ সুদে ঋণ নিতে। আবার সরকারের বরাদ্দ কৃষিঋণ নিতেও ধরতে হয় দালাল। কমিশনের নামে মোট ঋণের ১০ শতাংশই যায় দালালের পেটে। অনেক ক্ষেত্রেই প্রকৃত কৃষকরা পান না ঋণের টাকা। অনিয়মের কারণে বিভিন্ন জেলায় কৃষকের বরাদ্দের ঋণ চলে যাচ্ছে অকৃষি খাতে। কৃষকের জন্য বিশেষায়িত ‘১০ টাকার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট’ করতেও দিতে হচ্ছে ঘুষ। আবার নির্দিষ্ট সময়ে ঋণ শোধ না করায় বহু কৃষকের গলায় ঝুলছে সার্টিফিকেট মামলা। সেচের জন্য সরকার বিদ্যুৎ বিলে ২০ শতাংশ ভর্তুকি দিলেও এ ক্ষেত্রে কৃষকরা অনিয়মের শিকার হচ্ছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাঠ পর্যায়ের কৃষক সঠিকভাবে ঋণ, ভর্তুকিসহ নানা সুবিধা পাচ্ছেন কিনা সেদিকে সরকারের তদারকি বাড়াতে হবে। সরকারের এসডিজির দুই নম্বর লক্ষ্য অর্জন করতে হলে পিছিয়ে পড়া অঞ্চলে উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর মাধ্যমে ক্ষুধার অবসান, খাদ্য নিরাপত্তা ও উন্নত পুষ্টিমান অর্জন করতে হবে। একই সঙ্গে টেকসই কৃষির প্রসার এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্যের অবসান ঘটাতে হবে।
শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ উপজেলার ডিএমখালী ইউনিয়নে কৃষি ব্যাংকের শাখা থেকে সম্প্রতি আজহার সিকদার ভুয়া কাগজপত্র দেখিয়ে কলাবাগানের জন্য দুই লাখ ২০ হাজার টাকা ঋণ নেন। তবে কলাবাগানের কোনো অস্তিত্ব নেই। একই এলাকার কৃষক আক্তার হোসেন দেড় লাখ টাকা ঋণ নিতে ১২ হাজার টাকা ঘুষ দেন বলে অভিযোগ করেন। শহিদুল সরদার নামে আরেক গ্রাহক ৫০ হাজার টাকা ঋণ নিতে ব্যাংকের স্টাফকে ১০ হাজার টাকা ঘুষ দিয়েছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে। ডিএমখালী গ্রামের কৃষক দাদন মিয়ার অভিযোগ, ঋণ নিতে লাখে ১০-১২ হাজার টাকা ঘুষ লাগে। ঋণপ্রস্তাব থেকে শুরু করে টাকা পাওয়া পর্যন্ত পদে পদে দালাল ও ব্যাংক কর্মকর্তাদের হয়রানির শিকার হচ্ছেন দরিদ্র কৃষক।
অভিযোগ রয়েছে, ডিএমখালী ইউনিয়নের তালতলা গ্রামের কৃষকদের ঋণ পেতে তদবির করেন ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ফারুক সরকার। এ জন্য গ্রামের বাজারে তার নিজস্ব একটি অফিস রয়েছে। এলাকাবাসীর কাছে তা কৃষি ব্যাংকের অফিস বলেই পরিচিত। ফারুক সরকার দাবি করেন, গ্রামের মানুষ কাগজপত্র বুঝে না। তাই কাগজপত্র ঠিকঠাক করে দেন তিনি।
ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ হোসেন অনিয়মের অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, বছর কয়েক আগে এখানে অনেক দালাল ছিল। এখন কোনো দালালকে ব্যাংকে ঢুকতে দেওয়া হয় না।
কৃষি ব্যাংকের টাঙ্গাইলের নাগরপুর শাখা থেকে গাভি কেনার জন্য দুই লাখ টাকা ঋণ নিয়ে সেই টাকায় ছেলেকে বিদেশ পাঠান পরশ আলী। তার দাবি, ব্যাংকের দুই কর্মকর্তাকে আট হাজার টাকা ঘুষ দিয়ে ঋণ নেন তিনি। স্থানীয় কৃষকরা জানান, ঘুষ না দিলে ফাইল নড়ে না। এ বিষয়ে ভুক্তভোগীরা কৃষি ব্যাংকের প্রধান শাখা ও দুদকে অভিযোগ দিয়েছেন।
হবিগঞ্জের বানিয়াচংয়ে গরুর খামার করেছেন লুৎফুর রহমান। করোনার সময় কর্মীদের বেতন ও অন্যান্য খরচ জোগাতে বিক্রি করেন আটটি গাভি। সোনালী ব্যাংকের হবিগঞ্জ শাখায় দেওয়া তার প্রণোদনার ঋণ আবেদন আটকে আছে আশ্বাসে। তিনি বলেন, কর্মকর্তারা খামারে এসে তদন্ত করেছেন। ছয় মাস ঘোরার পর কাগজপত্র সঠিন নয় জানিয়ে ঘুষ দাবি করেন। এক লাখ টাকা ঘুষ দিলে ২০-২৫ লাখ টাকা ঋণ দেওয়ার কথা বলা হয়।
এভাবে অনেক কৃষক ঘুষ বাণিজ্যের শিকার হচ্ছেন। স্বল্প সুদে সরকারের এই কৃষিঋণের বিশেষ সুবিধা থেকে বাদ পড়ছেন তারা। জামানত ছাড়া মিলছে না ঋণ। কৃষি জমি নেই, এমন বর্গাচাষিদের জন্য নেই ঋণের সুযোগ।
এদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সহযোগিতায় অক্সফ্যাম ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) কৃষিঋণ ও কৃষিসেবার বিষয়ে চরাঞ্চলের কৃষকদের মধ্যে ‘গণতান্ত্রিক সুশাসনে জনসম্পৃক্ত প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণ’ শিরোনামে একটি সামাজিক নিরীক্ষা পরিচালিত করেছে। এই নিরীক্ষা প্রতিবেদনের একটি অংশে নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার কৃষকদের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। সাক্ষাৎকার নেওয়া ১০০ (সবাই ঋণগ্রহীতা) কৃষকের মধ্যে ৩৪ জন বলেছেন, ঋণ পেতে তদবির করতে হয়েছে। এর মধ্যে ৫ শতাংশ আবার অর্থের লেনদেনের কথা স্বীকার করেছেন। ৫৩ শতাংশের ক্ষেত্রে কৃষিঋণ পেতে জামানত, গ্যারান্টার বা বিশিষ্ট ব্যক্তির সহযোগিতা লেগেছে। ঋণ-সংক্রান্ত সমস্যা হলে ৮৯ শতাংশ কৃষক অভিযোগ করেন না।
কিশোরগঞ্জের নিকলী হাওরের ১০০ কৃষকের মধ্যে একই নিরীক্ষা করে দেখা গেছে, ৩৬ শতাংশ কৃষকের ঋণ পেতে তদবিরের প্রয়োজন হয়েছে। এখানেও ৬ শতাংশ কৃষক দালাল ধরে ঋণ নেওয়ার কথা স্বীকার করেছেন। প্রায় একই ধরনের চিত্র উঠে এসেছে কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জে পরিচালিত নিরীক্ষায়।
ধানসহ বিভিন্ন ফসল চাষে কৃষকের যে খরচ হয়, তার বড় অংশই আসে বেসরকারি ঋণ থেকে। এই ঋণের সুদও অনেক বেশি। আর সরকারি ঋণের সুদের হার কম হলেও কৃষক তা পান না বললেই চলে। আবার উৎপাদিত ধানের খুব সামান্যই কেনে সরকার। ফলে সুদে-আসলে সেই ঋণ শোধ করতে কৃষক কম দামে দ্রুত ধান বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন।
অক্সফ্যাম ও সিপিডির নিরীক্ষার তথ্য-উপাত্ত সংশ্নিষ্ট সেবা প্রদানকারী সংস্থার কর্মকর্তাদের সামনে গণশুনানির মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়। এতে বেশকিছু সুপারিশ উঠে আসে। কৃষিঋণ সেবা পেতে প্রকৃত কৃষক বাছাই করে কমিউনিটির নেতাদের সম্পৃক্ত করে ডেটাবেজ তৈরির জন্য সংশ্নিষ্ট দপ্তরগুলোর কাছে সুপারিশ করা হয়। এ ছাড়া জমির কাগজ, জামানত, গ্যারান্টার ছাড়া ঋণ, তদবির ও দালালমুক্ত ঋণ প্রদান, চাহিদা অনুযায়ী ঋণের বরাদ্দ, প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, আবেদনের পর দ্রুত ঋণ বরাদ্দ দেওয়া, ঋণের সুদের হার কমানো ও পরিশোধের সময় বাড়ানো, ঋণের বিপরীতে ঝুঁকি বীমা চালুসহ বিভিন্ন সুপারিশও করা হয় সংলাপে।
খাদ্যনীতি পরামর্শবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (ইফপ্রি) সমীক্ষায় বলা হয়েছে, এনজিও, আত্মীয়স্বজন, বেসরকারি ব্যাংক, দাদন ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন বেসরকারি উৎস থেকে কৃষক ৮১ শতাংশের বেশি ঋণ নেন। এসব ঋণের বড় অংশের সুদের হার ১৯ থেকে ৬৩ শতাংশ। সরকারের কৃষি ব্যাংক ৯ শতাংশ সুদে যে ঋণ দেয়, তা কৃষক খুব সামান্যই পান। কৃষকের মোট ঋণের মাত্র ৬ শতাংশ আসে কৃষি ব্যাংক থেকে। ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণের ভোগান্তি ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের অভাবেও অনেক কৃষক ব্যাংকমুখী হন না।
সারাদেশে দেড় লাখেরও বেশি কৃষকের নামে ঝুলছে সার্টিফিকেট মামলা। তবে মামলা চলাকালে গ্রাহকের সঙ্গে সমঝোতার (সোলেনামা) মাধ্যমে সার্টিফিকেট মামলা উত্তোলন বা নিষ্পত্তিপূর্বক ঋণ পুনঃতফসিল করা যাবে বলে ১ জুন বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সার্কুলার জারি করা হয়। কৃষকদের দাবি, সব সার্টিফিকেট মামলা অবিলম্বে বাতিল করে ঋণের দায় থেকে মুক্তি দিতে হবে।
কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, কৃষি ও কৃষকের সার্বিক উন্নয়নের জন্য করোনাকালে কৃষিঋণ সুষ্ঠুভাবে বণ্টন করতে হবে। এ জন্য মাঠে মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করা দরকার। ঋণের সুদ অবশ্যই ৪% হওয়া উচিত।
কৃষি ব্যাংকের চেয়ারম্যান মো. নাসিরুজ্জামান বলেন, কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে সারাদেশে পারিবারিক পুষ্টিবাগান স্থাপন কার্যক্রম চলছে। পুষ্টিবাগান স্থাপনে সরকারি সুবিধার বাইরের আগ্রহী কৃষক যাদের কমপক্ষে ১ শতক জমি আছে তাদের কৃষি ব্যাংক থেকে জামানত ছাড়াই ৫ হাজার টাকা করে ঋণ দেওয়া হবে।